।। এবাদত আলী।।
(পুর্ব প্রকাশের পর) (১৩)
(১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের সকালটা শুরু হয়েছিলো ‘রেডিও পাকিস্তানের’ এমন ঘোষণা শুনে। ‘‘আমি মেজর ডালিম বলছি, শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা ও তার সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশ বিডিআর ও রক্ষীবাহিনীর সিপাহী ভাইবোনেরা আপনারা সবাই সেনাবাহিনীর সাথে যোগদান ও সহযোগিতা করুন। যাহারা অসহযোগিতা করিবেন , দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাদের চরম দন্ড দেওয়া হইবে।’’)
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট রাত ৩ টার দিকে বঙ্গভবন থেকে ফোন এলো, লে: কর্নেল হামিদের কাছে। লে:কর্নেল এম এ হামিদ পিএসসি। সে সময় তিনি ঢাকা স্টেশনের দায়িত্বে ছিলেন।
তাঁর লেখা ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান এবং না বলা কিছু কথা ’ বইয়ে তিনি লিখেছেন,
৩২ নম্বর রোডের বাড়ি, শেখ মণি, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ অন্যন্য যারা ঐ ঘটনায় মারা গিয়েছেন তাদের মৃতদেহ বাসা থেকে কালেক্ট করে বনানী গোরস্থানে দাফন করতে হবে। তবে শেখ সাহেবের লাশ শুধু বাড়িতে থাকবে। স্থান পরে জানানো হবে।
লে: কর্নেল আব্দুল হামিদ তার বইতে লিখেছেন, তার পৌঁছানোর আগেই শেখ সাহেবের পরিবারের সব গুলো লাশ কফিন বন্দি করে সাপ্লাই ব্যাটালিয়নের ট্রাকে তুলে আমার আগমণের অপেক্ষা করছিলো। শুধু শেখ সাহেবের লাশ কফিন বন্দি করে বারান্দার এক কোনে ফেলে রাখা হয়েছে। লে: কর্নেল হামিদের মনে সন্দেহ হয়।। তিনি সুবেদারকে কফিনটি খুলতে বলেন। তখন দেখেন সেটা তার ভাই শেখ নাসেরের মরদেহ। সুবেদার এর ব্যাখ্যা দিয়েছিলো দুজনই দেখতে অনেকটা একই রকম, তাছাড়া রাতের অন্ধকারের কারণে এই ভুল।
সাপ্লাই ব্যাটালিয়নের সৈনিকরা বনানী কবরস্থানে এক টানা কাজ করে ১৮টি কবর খুঁড়ে রেখেছিলো। ভোর হওয়ার আগেই লাশ গুলো দাফন করা হয়।
তিনি লিখেছেন, লাশ গুলো দাফনের পর আমি আমার অফিসে ফিরে এক এক করে নামগুলো আমার অফিস প্যাডে লিপিবদ্ধ করি। এছাড়া আর কোথাও এই সমাধি গুলোর কোন রেকর্ড নেই।
বঙ্গভবন থেকে আবার মেসেজ পাঠানো হলো। শেখ সাহেবের ডেডবডি টুঙ্গিপাড়া পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। একটি এয়ারফোর্স হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেট জাতির পিতার প্রাণ কেড়ে নিলে পরদিন ১৬ আগস্ট-টুঙ্গিপাড়া তাঁর পারিবারিক কবরস্থানে মা-বাবার কবরের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর শেষ সময়ের সাক্ষীদের সেই কথা যেন হৃদয়ে গাঁথা। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আজো তাদের চোখ পানিতে ভিজে যায়।
বঙ্গবন্ধুর দাফনকারি টুঙ্গিপাড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. ইলিয়সি হোসেন বলেন, সেদিন টুঙ্গিপাড়া শোকে নিস্তব্ধ ও থম থমে অবস্থা বিরাজমান ছিলো। দুপুরের দিকে টু্িঙ্গপাড়া থানা সংলগ্ন হেলিপ্যাডে হেলিকপ্টারে করে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে আসা হয়। গ্যারিসন ডিউটি অফিসার মেজর মহিউদ্দিন আহমেদের তত্বাবধানে একটি বি এ এফ (বাংলাদেশ এয়ার ফোর্স) হেলিকপ্টারে করে বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফনের জন্য টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে আসা হয়। সোনবাহিনূর ঐ হেলিকপ্টারের পাইলট ছিলেন ফ্লাইট লেফটেনেন্ট শমশের আলী।
সেনা সদস্যরা নিচে নেমে অবস্থান করতে থাকে। পরে বঙ্গবন্ধুর কফিন বহন করার জন্য আমিসহ অন্যদের ডাকা হয়। তখন হেলিকপ্টার থেকে কফিন নামিয়ে টুঙ্গিপাড়া সোনলী ব্যাংকের ম্যনেজার আবুল কাশেম, আব্দুল হাই মেম্বার, আকবর কাজী , ইলিয়াস হোসেন, সোনা মিয়া কবিরাজ, শেখ নুরুল হক, গেদু মিয়া, সোহরাব মাষ্টারসহ আমরা হেলিকপ্টচারের মধ্য থেকে বঙ্গবন্ধুর কফিন বের করে তাঁর বাড়িতে নিয়ে আসি।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসা সেনা সদস্যরা দ্রুত কবর দেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু তখন মোলভী আব্দুল হালিম লাশ না দেখে দাফন করতে আপত্তি জানান। এ নিয়ে সেনা সদস্য ও মোীলভী সাহেবের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। পরে ম্যেলভী সাহেব একজন মুসলমানকে ইসলামী বিধান মেনে দাফনের দাবি জানান। তখন সেনা সদস্যরা ১৫ মিনিটের মধ্যে লাশ দাফনের অনুমতি দেন।
তখন আইয়ুব মিস্ত্রিকে দিয়ে কফিন খোলা হয়। বঙ্গবন্ধুর কফিন খোলা হলে দেখা যায় তার বুকে ২৪ টি গুলির চিহ্ন ছিলো। গুলি গুলো বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে গেছে। ডান হাতর তালুতে একটি গুলি, পায়ের গো-ড়ার পাশে একটি ও দুই রানের মাঝখানে দুটি গুলি ছিলো। তখনো তাঁর শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছিলো। গায়ে সাদা গেঞ্জি ও পাঞ্জাবী। পরনে ছিলো সাদা চেক লুঙ্গি। পাঞ্জাবীর এক পকেটে ছিলো চশমা ও পাইপ।
আশরাফ মোল্লার দোকান থেকে একটি ৫৭০ সাবান কিনে মান্নান শেখ, সোনা মিয়া, ইমাম উদ্দিন গাজী বাড়ির পাশের ডোবা থেকে বালতি ভরে পানি এনে গোসল করান। এরপর শেখ সায়েরা খাতুন রেডক্রিসেন্ট হাসপাতাল থেকে রিলিফের শাড়ি আনা হয়। শাড়ির লাল ও কালো পাড় ছিঁড়ে ফেলে কাফনের কাপড় বানানো হয়। এই কাপড় পরিয়ে (বর্তমান বঙ্গবন্ধুর বেদির সামনে) জানাজা পড়ানো হয় এবং বঙ্গবন্ধুর বাবা- মায়ের কবরের পাশে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়।
জানাজা ও দাফন শেষে বিশেষ মোনাজাত পরিচালনা করেন মৌলভী আব্দুল হালিম। সেনা ও পুলিশ হেফাজতে তড়িঘড়ি করে দাফন সম্পন্ন করা হয়। জানাজায় গ্রামবাসী অংশগ্রহণ করতে চাইলেও সে অনুমতি দেওয়া হয়নি।
টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আবুল বশার খায়ের বলেন, বঙ্গবন্ধুকে দাফনের জন্য আগেই কবর খুঁড়ে রাখা হয়। বঙ্গবন্ধুকে দাফনে গ্রামের মানুষ এগিয়ে আসেন, কিন্তু পথেই পুলিশ ও সেনা সদস্যরা তাদের বাধা দিয়ে আটকে দেন। কবর দেওয়ার পর সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। দাফনের পর কবর জিয়ারতও নিষিদ্ধ ছিলো। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদনে গিয়ে অনেকেই পুলিশের হাতে নাজেহাল হয়েছেন। তারপরও পুলিশের বাধা অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধুর অনুরাগীরা কবরে গিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।
সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ইতিহাসের পাতা থেকে চিরতরে মুছে ফেলতে চেয়েছিলো ঘাতকেরা। কিন্তু তাদের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বঙ্গবন্ধু বাঙালি চেতনায় চির অম্লান হয়ে রয়েছেন। আজ লাখো লাখো মুজিব সেনা ও মুজিব প্রেমী বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে ভক্তি ভরে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। । (সমাপ্ত)।
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
0 মন্তব্যসমূহ