সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

কবি বন্দে আলী মিয়ার আজ ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী

 


                             ।। এবিএম ফজলুর রহমান।।


“আমাদের ছোট গায়ে ছোট ছোট ঘর,

থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।

পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই,

এক সাথে খেলি আর পাঠশালায় যাই।”

অথবা

“বর্ষার জল সরিয়া গিয়াছে জাগিয়া উঠিয়াছে চর

গাঙ শালিকের গর্ত খুড়িয়া বাধিতেছে সবে ঘর”।

ময়নামতির চরের মত ও বিখ্যাত কালজয়ী কবিতার রচয়িতা কবি বন্দে আলী মিয়ার আজ ২৭ জুন ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৯ সালের ২৭ জুন রাজশাহীর কাজীহাটাস্থ বাসভবনে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরে পাবনার রাধানগরের কবির পৈত্রিক নিবাস ‘কবিকুঞ্জ’ এ তাকে সমাহিত করা হয়।

কোকড়ানো ঝাকড়া চুল, উন্নত নাসিকা, টানা চোখ, ভরাট মুখমন্ডল এবং স্নেহপ্রবণ হাসি মুখের অধিকারী কবি বন্দে আলী মিয়া নিরিবিলি ও অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের মানুষ ছিলেন। কখনো তাঁকে উত্তেজিত, রাগারাগি, চেচামেচি করতে দেখা যেত না। আপন ভুবনে তিনি বিচরণ করতেন। লেখালেখি নিয়েই তিনি সর্বদা ব্যস্ত থাকতেন। লেখালেখির জন্য তাঁর কোন বাঁধা ধরা সময় ছিল না।

১৯০৯ সালের ১৭ জানুয়ারী পাবনার শহরের রাধানগরের নারায়নপুর মহল্লায় জন্ম গ্রহণ করেন কবি বন্দে আলী মিয়া। তাঁর পিতার নাম ছিলেন মুন্সী উমেদ আলী মিয়া এবং মাতা নেকজান নেসা। কবির শৈশব ও কৈশোর কেটেছে পাবনার গ্রামীণ ও নাগরিক পরিমন্ডলে। মাত্র পাঁচ / ছয় বছর বয়সে তাকে রাধানগর মজুমদার একাডেমীতে (বর্তমানে আরএম একাডেমি) তাঁকে ভর্তি করা হয়। ১৯২৩ সালে সেখান থেকেই ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং চিত্রবিদ্যায় ডিপ্লোমার জন্য কলকাতাস্থ ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমীতে ভর্তি হন। পরে ১৯২৬ সাথে তাঁর পিতার ইচ্ছানুসারে শহরের জেলাপাড়া মহল্লার রাবেয়া খাতুনের সাথে তার প্রথম বিয়ে হয়। পরবর্তীতে তিনি আরো ৩টি বিয়ে করেন। ঐ তিন স্ত্রীর নাম হেনা, শামসুন্নাহার ও পরীবানু। 

তিনি ১৯২৭ সালে কৃতিত্বের সাথে চিত্র বিদ্যায় ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করেন এবং একই বছর কলকাতার আশুতোষ লাইব্রেরী কর্তৃক শিশুতোষ বই ‘চোরজামাই’ প্রকাশ করেন। পরে তিনি প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহীম খাঁ-এর অনুপ্রেরণায় করটিয়া সাদত কলেজে ভর্তি হয়ে কিছু কাল এফএ পড়েন।

১৯২৯ সালে অধ্যাপক মুহাম্মদ মনসুরউদ্দীন থাকতেন কলকাতার বালিগঞ্জের মে-ফেরারী রোডে। বাড়িওয়ালা ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবি বন্দে আলী মিয়া অধ্যাপক মনসুরউদ্দীদের সাথে দেখা করতে গেলে তিনি, সুরেনবাবু ও তাঁর বিদুষী স্ত্রী প্রজ্ঞা দেবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য কবিকে সেখানে নিয়ে যান। তাঁদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে আলাপ পরিচয় এমনকি স্বরচিত বই-পত্রেরও আদান প্রদান হয়। সে সময়ে কলকাতা করপোরেশন স্কুলসমূহের অধিকর্তা ছিলেন ক্ষিতীশ চট্টোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন এই দম্পতির জামাতা।

একদিন প্রজ্ঞা দেবী জামাতার কাছে কবি বন্দে আলী মিয়ার চাকুরির জন্য সুপারিশ করেন। তিনি কবিকে করপোরেশনের এক স্কুলে কবির চাকুরির ব্যবস্থা করে দিলেন। প্রায় ১৬ বছর কবি করপোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা করেন।

কলকাতায় থাকার সুবাদে সমকালীন পত্র-পত্রিকার সাথে কবি বন্দে আলী মিয়ার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর কিছুদিন পর কবি ‘ইসলাম দর্শন’ -এর সাথে জড়িয়ে যান। করপোরেশন স্কুলে শিক্ষক থাকাকালে তিনি ‘কিশোর পরাগ’, ‘শিশু বার্ষিকী’, ‘জ্ঞানের আলো’ প্রভৃতি মাসিক পত্রিকার সম্পাদনার কাজেও জড়িত ছিলেন।

১৯৩২ সালে কবি বন্দে আলী মিয়ার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘ময়নামতীর চর’ প্রকাশিত হয়। বইটি প্রকাশ করে কলকাতার ডি এম লাইব্রেরী। কবির এই ‘ময়নামতীর চর’ কাব্যগ্রন্থ পড়ে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রশংসাপত্র পাঠান। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর কবি ঢাকায় সাহিত্য লিখে এবং ছবি এঁকে জীবিকা নির্বাহ করতে শুরু করেন। কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৬২ সালে শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। পরে ১৯৬৫ রাজশাহী বেতার কেন্দ্রে স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসাবে চাকরি গ্রহণ করেন এবং একই বছর সাহিত্য-প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরুপ পাকিস্তান সরকারের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৮ সালের ২১ জানুয়ারি রাজশাহীর উত্তরা সাহিত্য মজলিস কর্তৃক সংবর্ধনা জ্ঞাপন এবং পদক ও পুরস্কার পান। অবশেষে কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৭৯ সালের ২৭ জুন রাজশাহীর কাজীহাটাস্থ বাসভবনে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। 

মহান এই কবির স্মৃতি রক্ষার্থে পাবনার আটঘরিয়ায় সাংবাদিক আমিরুল ইসলাম রাঙার উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে কবি বন্দে আলী মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজ। এ ছাড়া দীর্ঘ ৪৬ বছরেও পাবনায় গড়ে উঠেনি তেমন কোন প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৭ সালে তরুন কবি ও গবেষক মজিদ মাহমুদ, মরহুম আবু জাফর মুহম্মদ মোহসিন, মরহুম শফিকুল ইসলাম শিবলী, মোসতাফা সতেজ, আয়কর আইনজীবী মরহুম আব্দুল আজিজ, কবি আব্দুল্লাহেল বাকী, সাংবাদিক আখতারুজ্জামান আখতার, মরহুম আব্দুল মজিদ দুদু, ইসলাম হোসেন ইন্দা মিলে প্রথম বন্দে আলী স্মরণ পরিষদ গঠন করেন। কিছুদিন পরেই তার কার্যক্রম স্থিমিত হয়ে যায়। কবি বন্দে আলী মিয়াকে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ সরকারের মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়। কবি বন্দে আলী মিয়ার বর্ণাঢ্য জীবন এবং বিভিন্ন বৈশিষ্টের উপর বরেণ্য কবি ও সাহিত্যকগণ নানা স্মৃতি কথা লিখেছেন।

কবিকে স্মরণ করতে ও তার পরিবারের উদ্যোগে ২৭ জুন শুক্রবার সন্ধ্যায় পাবনার বনমালি শিল্পকলা কেন্দ্রে স্মরণসভা কবিতা পাঠ, পাবনার আটঘরিয়ায় কবি বন্দে আলী মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজের উদ্যোগে আলোচনা সভা এবং স্মৃতির চারণ সভার আয়োজন করা হয়েছে। 

লেখক : এবিএম ফজলুর রহমান, সাবেক সভাপতি, পাবনা প্রেসক্লাব।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ