সেই পুরনো মাইক্রোবাস আর আমাদের শৈশব।
প্রতিদিন সকালে মেয়েকে নিয়ে যখন পাবনা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের গেট দিয়ে ঢুকি, তখন নিজের ছোটবেলাকে যেন আবার হাঁটতে দেখি আমার পাশে। আমার মেয়েটা এখন ৫ম শ্রেণিতে পড়ে। স্কুল থেকে ফিরে এসে প্রায়ই বলে,
—“মা, জানো? ওই স্কুলের পেছনে একটা পুরনো মাইক্রোবাসের ছাদ পড়ে আছে, জানো? তৃষা বলে, ওখানে নাকি একসময় আস্ত একটা গাড়ি ছিলো! ওটার ভেতরে একটা কঙ্কাল আছে! কেউ কেউ বলেছে, ওই গাড়িটা নিয়ে নাকি অনেক আগে স্যারেরা পিকনিকে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়! একেকজন একেক রকম গল্প বলে! মা, কোনটা সত্যি ?”
আমি হাসি চেপে রাখতে পারি না। মেয়ের চোখে-মুখে আগ্রহ, ভয় আর বিস্ময়ের মিশেল। মনে পড়ে যায় আমার সেই ছোট্টবেলার কথা।
আমার বয়স তখন আট কি নয়। আমি আর আমার বন্ধুরা তখন সদ্য স্কুলে ভর্তি হয়েছি। স্কুলের পেছনে তখনও ওই পরিত্যক্ত গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল, চাকাবিহীন, মরিচায় ভরা, কাঁচহীন জানালা আর দরজার ভাঙা হুক—সেই মাইক্রোবাসে যেন লুকিয়ে ছিল শত গল্প। আমরা কেউ বলতাম, “ওই ভ্যানে রাতে আলো জ্বলে।” কেউ বলত, “একবার এক মেয়ে ঢুকেছিল, আর বের হয়নি!” কারো চোখে ছিল ভয়, কেউ ছিল সাহসী—গাড়ির কাছে গিয়ে চোখ রাখত জানালায়, আবার দৌড়ে পালাতো ভয়ে!
আমি নিজেও একদিন গিয়েছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে। খুব সাহস করে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, তখন মনের ভিতরে কেমন যেন হিমশীতল একটা অনুভূতি হচ্ছিল। আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বান্ধবী হঠাৎ বলল, “ওই যে কিছু নড়ছে!” ব্যস! আর কিছু না শুনে আমরা সবাই একসাথে “মা!” বলে দৌড়! হাঁটুর কাপুনি থামেনি আধঘণ্টা!
সেই গাড়িটা আসলে একসময় কোনো স্কুলের নানা কাজে ব্যবহার হতো। পরে সেটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায়, সেখানে ফেলে রাখা হয়েছিল। যত না বাস্তব ব্যবহার, তার চেয়ে বেশি হয়ে উঠেছিল কল্পনার ভাণ্ডার।
এখন আমার মেয়ে আর তার বন্ধুরা ঠিক আমাদের মতোই গল্প বানায়, কেউ ভয় পায়, কেউ সাহস করে কাছে গিয়ে দেখে, আবার ছোট ছোট গলায় হাসি চেপে বলে—“নড়লো না কি একটু?”
ভাবি, সময় বদলায়, মানুষ বড় হয়, কিন্তু ছোটদের কল্পনা আর শৈশবের সেই রহস্যভরা রোমাঞ্চ কখনো বদলায় না। ওই পুরনো গাড়িটা আজ আর নেই! কিছুদিন আগপর্যন্ত শুধু গাড়ির ছাদ খানা পরে থাকতে দেখতাম! তবে আমাদের সময়ে দেখতাম গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, ছায়ায় ঢাকা এক কোণে। আর আমাদের মতো আরও অনেক মেয়ে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম, নিজের মতো করে বুনে নিচ্ছিলাম একেকটা গল্প—ভয়ের, সাহসের, কৌতূহলের আর শৈশবের আনন্দের।
–একজন অভিভাবকের স্মৃতি চারণ
.jpeg)
0 মন্তব্যসমূহ