রনি ইমরান,পাবনাঃ আজ ১৬ অক্টোবর পাবনা জেলার ১৯৬ তম জন্মদিন। ১৭৯৩ সালে যখন চিরস্থায়ী বন্দবস্ত ব্যবস্থার প্রবর্তন হয় তখন দেশের আয়তন ও সীমারেখার পরিবর্তন ঘটে এবং রাজশাহীর অন্তর্ভুক্ত হয় পাবনা। ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে ১৬ অক্টোবর সরকারের ৩১২৪ স্মারকে জেলা হিসেবে পাবনা গঠিত হয়। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৭১ পর্যন্ত বর্তমান কুষ্টিয়া জেলা কুমারখালী এবং খোকসা থানা পাবনা জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে পাংশাকে পাবনা থেকে আলাদা করে ফরিদপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ সময় কুমারখালী ছিল দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম সমৃদ্ধ শহর, কুমারখালী ছিল পাবনা জেলার একটি মহাকুমা।
কিছু ইতিহাসবিদের মতে, পাবনা নামটি পদুম্বা থেকে এসেছে। কালক্রমে পদুম্বা শব্দটির স্বরসঙ্গতি হয়ে পাবনা হয়েছে।এছাড়া পাবনা নামকরণ নিয়ে কারও মতে, পাবন বা পাবনা নামে একজন দস্যুর আড্ডাস্থল থেকেই একসময় পাবনা নামের উদ্ভব হয়। এছাড়াও গঙ্গার পাবনী নামের একটি নদীর মিলিত স্রোতধারার নামানুসারে পাবনা নামের উৎপত্তি হয়েছে বলেও অনেকে মনে করেন।কেউ কেউ বলেন, পুন্ড্রবর্ধনের বংশধর রাজা জয়বর্ধনের আমলে পাবনা শহরের পাঁচ মাথা দূর্গামন্দির (বর্তমানে সোনাপট্রি) স্থানে পান্ডবভুমির একটি সাব-কাচারীবাড়ি প্রতিষ্ঠা পায়। উচ্চারনের সুবিধার্থে কালক্রমে পান্ডবখানা শব্দদ্বয় থেকে ন্ড এবং ‘খা’ বর্ণগুলো লোপ পেয়ে কালের বিবর্তনে পাবনা এ রূপান্তর হয়। ১৮৭৮ সালের ১৯ জানুয়ারি জেলায় প্রথম রেলপথ স্থাপিত হয়। প্রথম মোটর সার্ভিসের প্রবর্তন করা হয় ১৯২৬ সালে। পাবনা জেলার জন্মদিন পালনের সূচনা করেন দেশের ক্রিয়েটিভ আলোকচিত্র শিল্পী সাংবাদিক ও জাসাস পাবনা জেলা শাখার আহ্বায়ক খালেদ হোসেন পরাগ ।সেই থেকে শুরু গত বেশ কয়েক বছর যাবৎ পাবনা জেলার জন্মদিন বা প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী বিভিন্ন আয়োজনে পালিত হচ্ছে পাবনায় ।
নদী মাতৃক দেশে পদ্মা যমুনা ইছামতি আত্রাই বড়াল কাগেশ্বরী গুড় গুমানি চিকনাইয়ের মত রূপবতী নদী জেলায় প্রবাহিত হয়েছে।জানা যায়,১৯৪০ সালের পর পাবনা শহরে রিকশার প্রচলন ঘটে। হোসিয়ারী শিল্প, তাঁত শিল্প, কাঁচি শিল্প, বেনারসি-কাতান সহ অন্যান্য শিল্প সমৃদ্ধ এই জেলা একসময়ে ছিল দেশের অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র।পাবনার বর্তমান জেলা প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন মোহাম্মদ মফিজুল ইসলাম। দুই হাজার ৩৭১.৫০ বর্গকিমি আয়তন বিশিষ্ট পাবনা জেলায় ৯টি উপজেলা ও ৭৩টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। পাবনায় আদমশুমারি ২০২২ অনুযায়ী জেলার মোট জনসংখ্যা ২৯ লক্ষ ৯ হাজার ৬২৪জন। ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতিতে পাবনা জেলার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ভাষা সংগ্রাম আর সুমহান স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে সাম্প্রতিক ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থানে এই জেলার মানুষদের বীরত্বপূর্ণ অবদান ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। বিশ্ব বরেণ্য কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিক সাংবাদিক, শিল্প উদ্যোক্তা, বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, বিজ্ঞানী, অভিনেতা-অভিনেত্রী পাবনা তথা গোটাদেশকে বিশ্ব দরবারে স্বগৌরবে তুলে ধরেছে।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত নায়িকা মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের জন্মভুমি পাবনা। এ পাবনায় রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সব দর্শনীয় স্থান ও কালের স্বাক্ষী হয়ে থাকা ঐতিহাসিক স্থাপনা।পাবনার হেমায়েতপুরে রয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র মানসিক হাসপাতাল, সনাতন ধর্মালম্বীদের তীর্থস্থান শ্রী শ্রী অনুকুল ঠাকুরের জন্মভুমি । বৃটিশ স্থাপত্যের টেকসই নিদর্শন দেশের একমাত্র বৃহত্তর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ রেল সেতুর সাথে বর্তমানে লালন শাহ সেতু যুক্ত হয়ে এক সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হবার হাতছানি দিচ্ছে।
উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গের মধ্যে কবি ও সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী, ঔপন্যাসিক, শিশু-সাহিত্যিক কবি বন্দে আলী মিয়া, বিশ্ব বরেণ্য আকাশ যোদ্ধা সাইফুল আজম। একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক রণেশ মৈত্র, বাংলা আধুনিক ও চলচ্চিত্র সংগীতের গীতিকার ও সুরকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, ডা. ফজলে রাব্বী, রাজনীতিবিদ রফিকুল ইসলাম বকুল, ধর্মগুরু ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র, বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন (পদ্মশ্রী) সহ অসংখ্য গুণীজনের জন্মভূমি পাবনায়। পাবনার ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানের মধ্যে পাবনা শহরে অবস্থিত ঐতিহাসিক তাড়াশ ভবন, জোড় বাংলা মন্দির, পাবনা সদর উপজেলায় ভাঁড়ারা শাহী মসজিদ, পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রীজ, লালন শাহ সেতু, রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, আজিম চৌধুরীর জমিদার বাড়ি, গাজনার বিল, চলনবিল, চাটমোহর শাহী মসজিদ, শিতলাই জমিদার বাড়ি, হান্ডিয়াল জগন্নাথ মন্দির উল্লেখযোগ্য।
কৃষি প্রধান পাবনা জেলার অর্থনীতি বেশ সমৃদ্ধ। তাঁতশিল্প, হোসিয়ারি শিল্প, দুগ্ধজাত পণ্য এ জেলার ঐতিহ্যকে ধারণ করে। অর্থনৈতিক দিক থেকে ঈশ্বরদী উপজেলা বেশ সমৃদ্ধ । ঈশ্বরদীকে নিয়েই পাবনার অর্থনীতি গড়ে উঠেছে প্রচুর ছোটবড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে। ধান, পাট, গম, পেঁয়াজ, সবজি, লিচু, আম, ঘি, চলনবিলের মাছ ইত্যাদি এ জেলার অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।বিশ্ব দরবারে স্বগৌরবে তুলে ধরার দেশের একমাত্র পারমাণবিক প্লান্ট পাবনায় অবস্থিত। দেশের প্রাচীনতম জেলা পাবনা তবু উন্নয়নের দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে এতে হতাশা রয়ে গেছে মানুষের মনে। পাবনার মানুষের দীর্ঘদিন প্রাণের দাবীগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ঢাকা পাবনা সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ, শহরে ভয়াবহ যানজট নিরসন, শিশুদের জন্য আধুনিক বিনোদন পার্ক নির্মাণ, পাবনা মানসিক হাসপাতালের উন্নয়ন, পাবনা পৌরসভাকে সিটি কপোরেশনে উন্নীত করার দাবী এবং দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণে পাবনা জেলাকে সংযুক্তকরণ সহ বেশ কয়েকটি দাবী দীর্ঘদিন পাবনার জনমানুষের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে। এই সেতুতে পাবনা জেলা সংযুক্ত হলে রাজধানীর সাথে পাবনা সহ কয়েকটি জেলার যাতায়াতের দূরত্ব বর্তমান দূরত্বের চেয়ে ১০০ কিলোমিটার কমে যাবে। পাবনা তথা দেশের উত্তরের জেলাগুলোর মানুষেরও জীবন যাত্রার মান পাল্টে যাবে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য দিনে দিনেই বিক্রয় করে রাজধানী থেকে ফিরতে পারবে। পাবনা শহরের পেটের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা ইছামতি আজ মৃত পায়। এক সময় বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ যে ইছামতি দিয়ে রাজার মতন যেতেন নদীর সৌন্দর্য নিয়ে লিখতেন কবিতা। সেই ইছামতি নদী খননের অপেক্ষায় পাবনাবাসী আশায় বুক বেঁধেছে। দীর্ঘকাল পর পাবনার জন্য রেল সুবিধা এলেও রাজধানীর সাথে পাবনার সরাসরি যোগাযোগ হচ্ছে না। এতে কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ। পাবনার সকল মানুষের অভিপ্রায় পাবনার উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট প্রতিশ্রুতির দ্রুত বাস্তবায়ন হোক।
0 মন্তব্যসমূহ