প্রথম শ্রেণির পৌরসভা পাবনার ঈশ্বরদী। দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠানটির সব কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবেই চলছিল। বেতন-ভাতা ও বিদ্যুৎ বিলও দেওয়া হতো নিয়মিত। তবে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই আয় কমেছে। সরকারি বরাদ্দের টাকাও সময় মতো মিলছে না। ফলে অর্থ সংকটে পড়েছে পৌরসভাটি। তিন মাস ধরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বন্ধ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অর্থের অভাবে মশক নিধন, ময়লা-আবর্জনা অপসারণ, বৈদ্যুতিক সামগ্রী ক্রয়, রাস্তা-ঘাট সংস্কার, উন্নয়ন, বনায়নসহ পৌরসভার দৈনন্দিন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। এ পৌরসভায় প্রতি মাসে বেতন বাবদ ব্যয় হয় ৪৮ থেকে ৪৯ লাখ টাকা। এর বাইরে বিদ্যুৎ বিল ৪ লাখ, জ্বালানি ২ লাখ ও আনুষঙ্গিক খরচ ১ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে মাসে নিয়মিত ৫৬ লাখ টাকা খরচ হয়। এর পুরোটাই আসে পৌর কর, পানির বিল ও ট্রেড লাইসেন্সসহ নিজস্ব রাজস্ব আয় থেকে।
কয়েকদিনের টানা বর্ষণের পর জলাবদ্ধতা নিরসনের মতো অবস্থাও নেই পৌরসভাটির। বিভিন্ন সড়কে প্রয়োজনীয় ১২ হাজার বাতির বিপরীতে রয়েছে পাঁচ হাজার সড়কবাতির পয়েন্ট। এর মধ্যে অধিকাংশই জ্বলে না। ফলে রাতে বিভিন্ন এলাকা অন্ধকারে থাকছে। টাকার অভাবে বাতি কিংবা বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম কেনাসহ দৈনন্দিন কার্যক্রমও বন্ধ হওয়ার পথে। করের রিভিউ কার্যক্রম দু’মাস ধরে বন্ধ থাকায় আদায় অর্ধেকে নেমেছে।
ওয়ারিশ ও নাগরিক সনদের জন্য আবেদন করলে আগে একদিনেই পাওয়া যেত বলে জানান পৌর এলাকার সাঁড়া গোপালপুরের রফিকুল ইসলাম বাচ্চু। তিনি বলেন, এখন ৮-৯ দিন ঘুরেও অনেক ক্ষেত্র পাওয়া যাচ্ছে না। পিয়ারপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেনের ভাষ্য, দীর্ঘদিন ধরে এ এলাকার রাস্তা ভেঙে চলাচলের অযোগ্য হয়ে আছে। সংস্কারের জন্য পৌরসভায় বারবার আবেদন করেও কর্তৃপক্ষের সাড়া পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, পৌরসভার মধ্যে রেলওয়ে, সুগারক্রপ রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ডাল গবেষণা কেন্দ্র, কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, খাদ্যগুদামসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বছরে কর আদায় হয় অন্তত ৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে কর আদায় তলানিতে ঠেকেছে। এখনও ২০ ভাগ করও আদায় হয়নি।
সরকার পরিবর্তনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজস্ব ও কর আদায় কমায় পৌরসভার স্বাভাবিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, পৌর প্রশাসক, নির্বাহী কর্মকর্তা, নির্বাহী প্রকৌশলী, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, সহকারী প্রকৌশলীসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ১৬৮ জন। চালক, অফিস সহকারী, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, কুলি, ইমাম, মুয়াজ্জিনের মতো বিভিন্ন পদ ছাড়াও অনিয়মিত শ্রমিক আছেন ১০ থেকে ১৫ জন। তিন মাস ধরে তারা কেউ বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না।
পৌরসভার আদায় বিভাগের কর্মচারী মুকুল হোসেন বলেন, ‘তিন মাস বেতন পাচ্ছি না। এ অবস্থায় অর্থকষ্টে সংসার চালাতে পারছি না।’ নৈশপ্রহরী রোকনুজ্জামানের ভাষ্য, ‘শুধু আমার বেতনের ওপর পরিবার নির্ভরশীল। বেতন বন্ধ থাকায় প্রথম মাস ধার করে চলেছে। এখন বাকিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু কিনতেও পারছি না। বেতন না পেয়ে সংকটে পড়েছেন আমার মতো নিম্ন আয়ের অন্য কর্মচারীরাও।’
দুই মাস ধরে বিদ্যুৎ বিলও দিতে পারেনি পৌর কর্তৃপক্ষ। পৌরসভার পাঁচটি মোটরসাইকেল, একটি ভেকু, কঠিন পয়োঃবর্জ্য অপসারণের দুটি, ময়লা পরিবহন ও দুটি অফিসিয়াল গাড়িসহ যানবাহন আছে ১৫টি। এসবের জন্য মাসে জ্বালানি খরচ হয় প্রায় ২ লাখ টাকা। অর্থাভাবে জ্বালানি কেনাও কমেছে। অফিসের আনুষঙ্গিক খরচ ১ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও এখন এ খাতে খরচের অর্থ নেই।
রাস্তাঘাট ভেঙে চলাচলের অযোগ্য হয়ে গেলেও সংস্কারকাজ বন্ধ রয়েছে। হিসাব বিভাগ থেকে জানা গেছে, ঠিকাদার ও সরবরাহকারীদের পাওনা ৫-৬ লাখ টাকার বিল দিতে পারছে না পৌর কর্তৃপক্ষ। গত ১৬ আগস্ট পৌরসভার মেয়র ইছাহক আলী মালিথাকে অপসারণ করে পাবনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জাহাঙ্গীর আলমকে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর পর থেকে এক মাসে কোনো চেক ইস্যু হয়নি।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বন্ধের পাশাপাশি পানির মতো জরুরি বিভাগের প্রয়োজনীয় কোনো সামগ্রী কেনা যাচ্ছে না বলে জানান ঈশ্বরদী পৌরসভার পানি বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার বিশ্বাস। প্রধান হিসাবরক্ষক তাইবুর রহমান বলেন, আয় কমে যাওয়ায় পৌরসভার ফান্ডে দৈনন্দিন খরচ, পাওনা পরিশোধ বা এক মাসের বেতন দেওয়ার টাকাও নেই।
পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহুরুল ইসলাম এসব তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, অর্থ সংকটে বেতনসহ সব ধরনের কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। পৌরসভার প্রশাসক (অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক-রাজস্ব) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পৌরসভার নাগরিক সেবার অন্য কার্যক্রম চলছে। তবে টাকা না থাকায় বেতনসহ পাওনা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে।
0 মন্তব্যসমূহ