সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

লোকসানের মুখে পাবনার পোলট্রি খামারিরা


ফয়সাল মাহমুদ পল্লব: পাবনায় হুমকির মুখে ১০ হাজার পোলট্রি খামারি। পাবনার খামারিরা বলছেন অব্যাহতভাবে বেড়েছে মুরগির খাবারের দাম। লোকসান টানতে টানতে তাদের হিমশিম অবস্থা। বাধ্য হয়ে অনেকে খামার বন্ধ করে দিচ্ছেন। এতে কমছে ডিমের উৎপাদন। 

ডিমের দাম বাড়লেও লাভবান হচ্ছেন না খামারিরা। উল্টো মুরগির খাদ্যদ্রব্য ও পরিবহন ব্যয় বাড়ায় তাদের লাভ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছেন পাবনার অন্তত ১০ হাজার খামারি। পাবনার খামারি ও পাইকাররা বলছেন, ডিমের দাম বাড়ায় লাভ যাচ্ছে খুচরা ব্যবসায়ীদের পকেটে। আমরা ডিমপ্রতি ২০ পয়সা লাভ করলেও তারা দুই টাকার বেশি লাভ করছে।

বেশ কয়েকজন খামারি জানান, তারা প্রতি ডিমে ২০ পয়সা লাভ করেন। আর পাইকাররা বলছেন, আমরা একশ ডিম বিক্রি করে পাঁচ টাকা লাভ পাই। খুচরা ব্যবসায়ীরা এক ডিমেই লাভ করছে দুই টাকার বেশি। কারসাজি খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে। 

পাবনা সদর উপজেলার মুরগির খামারি রোকনুজ্জামান জানান, মুরগির খাদ্যের প্রতি বস্তার (৫০ কেজি ওজন) দাম পরিবহনসহ ২৮০০ থেকে ২৯০০ টাকা হয়েছে। প্রতিদিন একটি মুরগি গড়ে খাদ্য খায় ১২০ থেকে ১৩০ গ্রাম। সে হিসাবে ১০০ মুরগির প্রতিদিন খাদ্য লাগে প্রায় ১২ থেকে ১৩ কেজি। যার বর্তমান মূল্য প্রায় ৭০০ টাকা। এর সঙ্গে প্রতিদিন বিভিন্ন ওষুধ লাগে গড়ে ৫০ টাকা এবং এর সঙ্গে লেবার খরচ রয়েছে।

এছাড়া ফার্মে নিরবচ্ছিন্নভাবে বৈদ্যুতিক ফ্যান চালাতে হয়। তার বিল দিতে হয়। প্রতি ১০০ মুরগিতে গড়ে ডিম পাওয়া যায় ৭০ থেকে ৮০টি। সব মিলে ১০০ মুরগিতে প্রতিদিন গড় আয় ৭০০- ৮০০ টাকা। কিন্তু এর বিপরীতে সমপরিমাণ ব্যয় হয়ে যায় বলে দাবি করেন রোকনুজ্জামান।

তিনি আরও জানান, যেসব খামারি লেবারের পরিবর্তে ব্যক্তিগতভাবে শ্রম দেন একমাত্র তারাই লাভের মুখ দেখছেন। 

এদিকে পাবনার আটঘরিয়া উপজেলায় ছোট-বড় প্রায় ২০০ মুরগির খামার ছিল। ক্ষতির কারণে ইতিমধ্যেই ৪০ খামার বন্ধ হয়ে গেছে এবং আরও ২০ খামার বন্ধ হওয়ার পথে। খাদ্যের দাম ও ভেটেনারি ওষুধের দাম বাড়ায় এমন অবস্থা হয়েছে। খামারিদের রক্ষায় অবিলম্বে খাদ্যের ও ভেটেনারি ওষুধের দাম কমানো দরকার বলে মনে করছেন খামারিরা।

আটঘরিয়া উপজেলার শফিকুল ইসলাম নামে এক খামারি জানান, খাবার, ওষুধ ও পরিচর্যা ব্যয়সহ একটি লেয়ার মুরগি ডিম দেওয়ার উপযোগী করতে উৎপাদন ব্যয় কমপক্ষে ৭০০ টাকা। ডিম দেওয়া শুরু করলে মুরগিটি প্রতিদিন আট টাকার খাবার খায়। খামারের সব মুরগি খাবার খেলেও প্রতিদিন ডিম দেয় না। পাশাপাশি কোন কারণে মুরগি মারা গেলে সর্বস্বান্ত হন খামারিরা।

পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বনগ্রাম এলাকার খামারি এবং পাইকারি ব্যবসায়ী আফজাল হোসেন জানান, গত বছর খাবারের দাম যা ছিল, এ বছর তা দ্বিগুণ হয়েছে। খাবার ও ওষুধের দাম বাড়ার কারণেই মূলত ডিমের দাম বেশি।

তিনি জানান, তার নিজের একটা খামার ছিল। ৫০ হাজার টাকা ক্ষতি হওয়ায় বন্ধ করে রেখেছেন। খাবারের এবং ওষুধের দাম না জেনে অনেকে ডিমের ব্যবসায়ীদের দোষ দেন। আসলে পাইকাররা খুব কম লাভে ডিম বিক্রি করেন।

সদর উপজেলা প্রান্তিক পোলট্রি খামারি সমিতির আহ্বায়ক হেলাল উদ্দিন জানান, প্রান্তিক পোলট্রি খামারিদের বাঁচাতে সরকারের জরুরি ভিত্তিতে কিছু উদ্যোগ নেওয়া দরকার। এ খাত ধ্বংস হলে পাবনা জেলায় সহস্রাধিক খামারি বেকার হয়ে পড়বে। পোলট্রি খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে খাদ্য ও বাচ্চার দাম কমানো জরুরি।

তিনি জানান, ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা খাদ্যের দাম কমিয়ে ১৮০০ টাকা নির্ধারণ করা দরকার। এছাড়া প্রান্তিক খামারিদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করলে তারা টিকে থাকতে পারবে।

পাবনা জেলা প্রান্তিক পোল্ট্রি শিল্প সংগঠনের আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম বলেন, বর্তমান সময়ে মুরগির বাচ্চা ও খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই মুরগি ও ডিম উৎপাদন শুরু করেছে। নিম্নমানের খাবার ও বাচ্চা সরবরাহ করে প্রান্তিক খামারিদের ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। বাজারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতেই পরিকল্পিতভাবে প্রান্তিক খামারিদের ধ্বংসের ষড়যন্ত্র চলছে। এ খাতে সরকারি নজরদারি না হলে অচিরেই প্রান্তিক পোলট্রি শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।

তিনি আরও বলেন, মুরগির বাচ্চা ও খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পাবনায় ১০ হাজার খামার হুমকির মুখে পড়েছেন।

অন্যদিকে, ডিমের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় দিশেহারা ক্রেতারা। সদর উপজেলার টেবুনিয়ার বাসিন্দা স্কুল শিক্ষক মো. নাসিম উদ্দিন জানান, বর্ষা মৌসুমে হাঁসের ডিমের প্রাচুর্য থাকায় দাম কম থাকে। কিন্তু এবার ব্রয়লার মুরগির ডিমের দাম না কমায় হাঁসের ডিমেরও দাম বেশি।

তিনি আরও বলেন, সংসারে ডিম অতি প্রয়োজনীয়। নাস্তার টেবিল থেকে শুরু করে শিশুদের টিফিনে থাকতে হয় ডিম। অথচ এত দাম বাড়ার কারণে সীমিত আয়ের মানুষের হিমশিম অবস্থা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) পাবনার সাধারণ সম্পাদক এসএম মাহবুব আলম জানান, ডিমের অসাধু আড়তদার, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়িদের বিরুদ্ধে সরকারি অভিযানের বিকল্প নেই। যথাযথ মনিটরিং হলেই বাজার সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে।

পাবনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আল মামুন হোসেন মন্ডল বলেন, বাজারে ডিমের দাম প্রায়ই ওঠা-নামা করে। সরকার প্রান্তিক খামারিদের প্রতি আন্তরিক। তবে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আগেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কেউ কারসাজি করার চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি বলেন, এবারও প্রশাসনের সহযোগিতায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। এতে সুফল পাওয়া যাবে।


(ছবি- নিজস্ব)

ফয়সাল মাহমুদ পল্লব

পাবনা

01716755135

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ