।।এবাদত আলী।।
(পুর্ব প্রকাশের পর )
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে পাবনা সদর থানার পশ্চিমাঞ্চলে নকশাল দমনের জন্য পাকিস্তানি সেনাদেরকে ভুল বুঝিয়ে মুক্তি বাহিনী দমনের কথা বলে পাবনা শহর থেকে পাকিস্তানি সেনার একটি শক্তিশালী বহর মনের আনন্দে মুক্তিবাহিনীদেরকে কুপোকাত করতে রওনা হয়। আব্দুল আজিজ মন্ডল ও আফছার আলী মোল্লা নামে দুজন সাহসি ব্যক্তি বোরকা পরিহিত অবস্থায় তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। এর আগে তারা আর্মি অফিসারের নিকট গিয়ে বলেনযে, আমাদের এলাকায় মুক্তিবাহিনীরা ঘাঁটি গেড়ে এলাকার লোকজনকে দারুন হয়রানি করছে। তারা একটি বাংকার খনন করে রাতে সেখানে থাকে এবং দিনের বেলা বিভিন্ন স্থানে গিয়ে অন্যায় অত্যাচার করে। তারা আরো জানায় যে ঐ মুক্তি বাহিনীরা এলাকার সুন্দরী মেয়েদেরকে ধরে তাদের বাংকারের মধ্যে আটকে রেখে তাদের উপর যৌন নিপিড়ন করে। আর্মি অফিসার তখন বলে কেয়া বাত? মুক্তি হায় ? আওর মুক্তি কি ছাত আওরতভি হায়। ঠিক হায় হাম উহাপর জরুর জায়েগা। এইসব কথা বলে তাদেরকে বলে কথা যদি মিথ্যা হয় তবে তোমাদের জীবন খতম করে দেয়া হবে। সুযোগ বুঝে তারা বলে হুজুর সব কথা সত্যি হায়। আজকে রাতেই চলেন হুজুর ওদের দেখা মিলতা হায় হুজুর।
যে কথা সেই কাজ তাদেরকে আর্মি ক্যাম্পে আদর যত্নে রাতের খানা খাওয়ানো হলো। তারা ভাবে যে আমাদের এই বুঝি শেষ খানা খাওয়া। শেষ রাতে তাদের সেহেরি খেতে দেওয়া হয়। তারপর দুজনকে দুটি বোরকা পরানো হয় এবং পৃথক দুটি মিলিটারি কনভয়ে উঠানো হয়।
এদিকে নকশালেরা সেসময় দাপুনিয়া ইউনিয়নের কলাবতি গ্রামে ভাদুর মার বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে মাটি খুড়ে খুড়ে বিরাটকায় গর্ত তৈরি করে সেই নিরাপদ গর্তে তারা থাকতো। সেখানে জীবন যাপনের সব রকম ব্যবস্থাই তারা করে রেখেছিলো। অপর দিকে আমাদের মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা রত্নাই নদীর (বাঙর নদী) দক্ষিণ পাড়ে বাঙ্গাবাড়িয়া বাদালপাড়া ও নওদাপাড়া গ্রামে পজেশন নিয়ে থাকে।
সে এক রোমাঞ্চকর ও ভয়াবহ অপারেশন। পাকিস্তানি সৈন্যরা যদি ঘুনাক্ষরে জানতে বা বুঝতে পারে যে তাদেরকে ভুল বুঝিয়ে মুক্তি বাহিনী হত্যার বদলে তাদেরই আপন লোকজন নকশাল বাহিনীকে হত্যা করতে চলেছে তখন যে কি উপায় হবে তা ভেবে ভেবে দুজন তখন ঘেমে একেবারে নেয়ে উঠেছে। তারা শুধু আল্লাহ আল্লাহ করছে যেন নকশালদের সেই নির্ধারিত ঘাঁটিতে সকলকে একসঙ্গে পাওয়া যায়।
পরিকল্পনা মোতাবেক আর্মির কনভয় গুলো টেবুনিয়া সিড গোডাউন হয়ে দরিকামালপুর, চকভবানি ও জোতআদম হয়ে কলাবতির নিকটে গিয়ে প্রাথমিকভাবে দু একটি গুলি ছোঁড়ে। গুলির শব্দে নকশাল ক্যাম্পে পাহারারত নকশালও গুলি ছুঁড়ে তার জবাব দেয়। তারা মনে করেছিলো মুক্তিবাহিনী তাদের উপর আক্রমণ করেছে। তাই তারা বেশি আমল দেয়নি। কিন্তু যখন বৃষ্টির মত এলএমজি ও এইচ এমজির গুলি চালানো হতে থাকে তখন তাদের মধ্যে আতংক দেখা দেয়। সর্বনাশ এমন অস্ত্রতো মুক্তিবাহিনীর হতে পারেনা। নিশ্চয় মিলিটারি তাদের আক্রমণ করেছে। কিন্তু মিলিটারিরাতো তাদের বন্ধু। তারা কোনস্থানে বিপদে পড়লে মিলিটারিরাইতো তাদেরকে প্রোটেকশন দেয়। তবে কেন এমনটি হলো। এমনি ভাবতে ভাবতে আর্মিরা তাদের বাংকারের প্রায় কাছাকাছি এসে পড়ে। আফছার মোল্লা আর আবদুল আজিজ মন্ডল তখন বলে হুজুর এই দেখেন ইরাই মুক্তি হায় হুজুর। আর্মি অফিসার খুশি হয়ে বলে তোম লোগ সাচ বাত কাহতা হায় । তোম সাচ্চা আদমি হায়।
এমন অনাকাঙ্খিত আক্রমণের মাঝে পড়ে নকশালেরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। তখন আর কোন উপায় না দেখে তারা যে যার মত প্রাণ বাঁচাতে গর্ত থেকে বেরিয়ে যে যেদিকে পারে ছুটতে শুরু করে। এলাকার লোকজনের কাছে আগে থেকেই গোপনে বিষয়টি জানিয়ে রাখা হয়। তারা যেন কোন নকশালকে কোনরূপ সহযোগিতা না করে। এলাকার সকল শ্রেণির মানুষ তখন তাদের উপর অতিষ্ঠ হয়ে আছে। সুযোগ পেলে তারা তা কাজে লাগাবে।
কথায় বলে আল্লাহর মাইর দুনিয়ার বাইর। এদিন নকশালদের কপালেও তাই ঘটে গেল। মুক্তিযোদ্ধারা পজেশন নিয়ে রয়েছে। তারা এলেই গুলি করে হত্যা করা হবে। কিন্ত তার আর প্রয়োজন হলোনা। এলাকার লোকজন যখন দেখলো যে নকশালেরা সাঁতরিয়ে নদী পার হচ্ছে তখনই তারা তাদের উপর চড়াও হয়। তারা এতক্ষনে দা, বটি, হাসুয়া, ফালা-সড়কি ইত্যাদি নিয়ে নকশাল নিধনের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। ব্যাস আর যায় কোথা। তারা পলায়নরত এলাকার নকশাল নামধারি প্রায় ৪০ জনকে হত্যা করে মনের জালা মিটায়। সুযোগ বুঝে জনতা এদের মধ্যে দু একজনকে জ্যান্ত কবর দেয়।
আর্মিরা সেই বাংকারে গিয়ে প্রচুর গোলাবারুদ, কয়েকটি খাসি, কয়েক বস্তা চাউলসহ বিভিন্ন দ্রব্যাদি উদ্ধার করে নিয়ে যায়। তারা মুক্তি বাহিনী ভেবে নকশালদের ধরতে নদী পার হয়। নদীর দক্ষিণ পাড়ে হালিম প্রামানিকের বাড়ির পাশে তখন গ্রামের কিছু ব্যক্তি দাঁড়িয়ে রহস্য দেখছিলো। কিন্তু আর্মিদের ধারণা এরাই মুক্তি ফৌজ। তাই তারা গুলি করে বাদলপাড়া গ্রামের তোরাপ আলী, বাঙ্গাবাড়িয়া গ্রামের নায়েব আলী, আবেদ আলী, আহম্মদ আলী, উকিল উদ্দিন, গোকুল সরদার, খবির মন্ডল, ইসমাইল খাঁসহ বেশ কয়েকজন নীরিহ ও নিরপরাধ ব্যক্তিকে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। আর্মিরা এরপর পাবনার পথে অগ্রসর হতে থাকে।
তারা শ্রীকৃষ্টপুরের শহীদ, নকশাল নেতা জোমশেদকে মালিগাছা কলমবাগান পর্যন্ত ধরে নিয়ে গিয়ে সেখানে গুলি করে হত্যা করে চলে যায়। যাবার সময় সন্ধানদাতা দুজনকে সাবাস বলে ধন্যবাদ দিয়ে চলে যায়। এদিন থেকে এই এলাকা নকশাল মুক্ত হয়।(চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
0 মন্তব্যসমূহ