।। এবাদত আলী।।
বাংলাদেশে শিক্ষার হার ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। বাড়ছে শিক্ষিতের হার। জ্ঞান চর্চার প্রসার ও ঘটছে অতি দ্রুত। পাশাপাশি লেখক ও কবি সাহিত্যিকের সংখ্যা যে আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা বিশ্বাস করার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। কেবল কবি সাহিত্যিক তথা সাহিত্য রূপকারদের সাহিত্য রস ভান্ডার পুর্ণরূপে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে বন্ধ্যা ভাবের ঘোরঅন্ধকার যেন কিছুতেই অপসারিত হচ্ছেনা। বিশেষ করে মফস্বল এলাকার সাহিত্য প্রেমিকের মনোবাসনা কানায় কানায় পুর্ণ হবার ক্ষেত্রে রয়েছে দারুন বাধা। মফস্বল এলাকার কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, এক কথায় যে কোন ধরনের লেখকের কথাই বলা হোকনা কেন, তাদের সৃজিত রচনাবলি পুস্তক আকারে প্রকাশের ব্যাপারে তেমন কোন পৃষ্ঠপোষকতা নেই বল্লেই চলে।
বই বা সাহিত্য পাঠকের সংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, মফস্বল এলাকায় বই প্রকাশের মাত্রা তেমন বৃদ্ধি পাচ্ছেনা। মনন শক্তি বা হৃদয় বৃত্তিকে পুর্ণরূপে জাগ্রত করতে একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সাথে রচনাবলি লিপিবদ্ধ করে মফস্বলের লেখকদের দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়। ধর্ণা দিতে হয় পত্র পত্রিকার সম্পাদক এবং বই প্রকাশের প্রকাশনালয়ের কর্তা ব্যক্তির নিকট।
ঐ সকল কবি সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, জীবনবোধের অন্তহীন রহস্য উদ্ঘাটন করে পান্ডুলিপি রচনা করেন বটে; কিন্তু তা প্রকাশের অভাবেই পাঠক মহলের দোরগোড়ায় পৌঁছেনা। বই বা সাহিত্য রচনার মধ্য দিয়ে লেখকগণ মানব কল্যানে ব্রতি হয়ে যে সত্য সন্ধান করেন তা অনেক সময় ইঁদুর, উঁইপোকা আর তেলাপোকার উদর পুর্তি ছাড়া পাঠক সমাজে উপস্থাপিত হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
আমাদের দেশে সাহিত্য চর্চার পরিষ্ফুটনের ধাপ নগরকেন্দ্রিক। তাই গ্রাম গঞ্জের পরিমন্ডল হতে নগর মহানগরের আলো ঝলমল পরিবেশের পরশে কত লেখক যে খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করতে সক্ষম হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। অপর দিকে গ্রামীণ পরিবেশের বেড়াজাল ছিন্ন করে নগর- মহা নগরিতে স্থান করে নিতে না পারায় অনেক খ্যাতিমান লেখক যে উৎসাহ হারিয়ে পাতা ঝরা বৃক্ষের কান্ডের ন্যায় ঠায় দাড়িয়ে পড়েছেন তা গণনা করে শেষ করা যাবেনা।
যে কোন রচয়িতার রচনাবলি যদি বই এর আকারে পাঠকের হাতে না পৌঁছে , পাঠক বর্গ যদি লেখকের চিন্তা চেতনা সম্পর্কে অবগত হবার সুযোগ হতে বঞ্চিত হয় তাহলে লেখক আর পাঠকের মাঝে সেতুবন্ধন রচনা হয় কি প্রকারে।
মফস্বল শহরের কোন এক কবির কথা জানি। অনেক ধার দেনা করে তিনি এক খানা কবিতার বই প্রকাশ করেছিলেন, প্রকাশনা উৎসব ও করেছিলেন ঘটা করে। গন্যমান্য ব্যক্তি, সরকারি আমলাসহ জ্ঞানী-গুণীদের উপস্থিতি ছিলো ব্যাপক। বইটির আলোচনা সমালোচনা হয়েছিলো ঢের। তবে প্রশংসার পাল্লা বেশ ভারিই ছিলো, কিন্তু পরবর্তীকালে বইয়ের কাটতি নিয়ে তিনি বিপাকে পড়েন। লাইব্রেরি গুলো নতুন লেখকের বই, বিশেষ করে মফস্বল লেখকদের বই বিক্রি করতে নিরুৎসাহ বোধ করেন।
বই বা সাহিত্যের মধ্য দিয়ে মানুষ সত্য, কল্যাণ আর সুন্দরের সন্ধান পায়। কিন্তু রচিত বই প্রকাশের সুযোগের ক্ষেত্রে যদি প্রতিবন্ধকতা থাকে তবে সে সকল কল্যাণের ধনভান্ডার অসুন্দরের বন্ধনে আবদ্ধ হতে বাধ্য। সত্য কথা বলতে কি নগর-মহানগর ছাড়াও মফস্বল শহর হতে গ্রাম-গঞ্জে মননশীল পাঠকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন ধাঁচের লেখকের সংখ্যাও কম নয়। সে তুলনায় প্রকাশক বা প্রকাশনা সংস্থার সংখ্যা বলতে গেলে শুন্যের কোঠায়। গ্রাম-গঞ্জের লেখকগণ বই প্রকাশের জন্য তেমন প্রকাশক পাননা। কোন কোন লেখক অতি উৎসাহি হয়ে নিজের অর্থ-কড়ি খরচ করে বই প্রকাশ করলেও বিপনন ব্যবস্থা অনুকুলে নয়। ফলে মুদ্রিত বই বিক্রি না হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই লেখা লেখিতে ভাটা পড়ে। প্রখ্যাত লেখক বিমলমিত্র বলেছেন “লেখকদের ধৈর্য হারাতে নেই”। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্য চর্চার পর সে সাহিত্য যদি পাঠক সমাজের গোচরিভূত না হয় তা হলে লেখনির মৃত্যু অবধারিত। মফস্বলে বসবাস করার ফলে সাহিত্য সাধনা যেন তাদের কাছে বিড়ম্বনার শামিল। নগর মহানগর কেন্দ্র্রিক প্রকাশনা ব্যবস্থাকে মফস্বল পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে এ বিড়ম্বনার অবসান হওয়া সুকঠিন।
দেশে ভারি শিল্প, মাঝারি শিল্প, এমনকি ক্ষুদ্রয়াতকার শিল্প কারখানা গড়ে তোলার ব্যাপারে উৎসাহের কোন কমতি নেই, নেই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। ঐ সকল খাতে ঋন মঞ্জুর হয় মোটা অংকের। নগর-মহানগর এলাকার প্রকাশনা শিল্প ও তা থেকে বাদ যায় না। কিন্তু মফস্বল এলাকার প্রকাশনা শিল্প গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তেমন উৎসাহ উদ্দীপনা ও পৃষ্ঠপোষকতা আছে বলে মনে হয়না। পল্লী অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য সরকার এবং বেসরকারি সংস্থা সমুহ প্রানান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে কামিয়াবও হয়েছে। পল্লী অঞ্চল তথা মফস্বলের লেখকদের বই প্রকাশের ব্যাপারে তেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকার উদাহরণ আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ লোক গ্রামে বাস করে। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠির মাঝে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চাকারির সংখ্যাকে খাটো করে দেখা আদৌ ঠিক নয়।
পল্লী অবকাঠামো উন্নয়নের পাশা পাশি পল্লী অঞ্চল তথা মফস্বল এলাকার সৃজনশিল লেখকদের রচিত বই প্রকাশের ব্যাপারে যত্নশিল হতে হবে। সার্বিক সহায়তাদানের মাধ্যমেই কেবল তা সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকার এবং বেসরকারি সংস্থা সমূহকে এগিয়ে আসতে হবে। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
0 মন্তব্যসমূহ